বাংলা ফ্লো প্রতিবেদক
ঢাকা: ঈদযাত্রা শুরুর দিন ২৪ মার্চ থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ০৭ এপ্রিল পর্যন্ত ১৫ দিনে দেশে সড়ক, রেল ও নৌ পথে সর্বমোট ৩৪০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩৫২ জন নিহত ও ৮৩৫ জন আহত হয়েছে।
শুধুমাত্র দেশের সড়ক-মহাসড়কে এই ১৫ দিনে ৩১৫ টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২২ জন নিহত ৮২৬ জন আহত হয়েছে। সে হিসেবে ১৫ দিনের ঈদ যাত্রায় দৈনিক গড়ে ২১ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
একই সময়ে রেলপথে ২১টি দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত, ০৮ জন আহত হয়েছে। নৌ-পথে ০৪ টি দুর্ঘটনায় ১০ জন নিহত, ০১ জন আহত ও ০১ জন নিখোঁজ রয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
বুধবার (৯ এপ্রিল) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে যাত্রী কল্যাণ সমিতি আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী এসব তথ্য তুলে ধরেন।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এবারের ঈদে ১৩৫ টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৫১ জন নিহত, ১৫৫ জন আহত হয়েছে। যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪২.৮৫ শতাংশ, নিহতের ৪৬.৮৯ শতাংশ এবং আহতের ১৮.৭৬ শতাংশ প্রায়।
এই সময় সড়কে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত ৭০ জন চালক, ৪৭ জন পরিবহণ শ্রমিক, ৫০ জন পথচারী, ৬০ জন নারী, ৪০ জন শিশু, ৩৩ জন শিক্ষার্থী, ২০ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, ০৬ জন শিক্ষক, ০৪ জন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, ০১ জন সাংবাদিকের পরিচয় মিলেছে।
সংগঠিত দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ৩২.২৭ শতাংশ মোটরসাইকেল, ১৬.৫৬ শতাংশ বাস, ১৪.৮৬ শতাংশ ব্যাটারিচালিত রিকশা, ১৪.৪৩ শতাংশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান, ৮.০৬ শতাংশ কার-মাইক্রো, ৭.২১ শতাংশ নছিমন-করিমন ও ৬.৫৮ শতাংশ সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসব দুর্ঘটনায় জড়িত ছিল।
দুর্ঘটনার ২৭.৩০ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৪২.২২ শতাংশ পথচারীকে গাড়ি চাপা দেয়ার ঘটনা, ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনায়, ১.৫৮ শতাংশ ট্রেন-যানবাহনে, ০.৩১ শতাংশ চাকায় ওড়না পিছিয়ে ও ৮.৫৭ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে দুর্ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, মোট সংঘটিত দুর্ঘটনার ৩৮.৪১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ২১.২৬ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ৩৪.৬০ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়। এছাড়াও সারাদেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৩.৪৯ শতাংশ ঢাকা মহানগরীতে, ০.৬৩ শতাংশ চট্টগ্রাম মহানগরীতে ও ১.৫৮ শতাংশ রেলক্রসিংয়ে সংগঠিত হয়েছে।
এবারের ঈদে সংগঠিত দুর্ঘটনার কারণসমূহ:
১. দেশের সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল, ব্যাটারিচালিত রিকশা, অটোরিকশা অবাধে চলাচল।
২. জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা।
৩. সড়কে মিডিয়ামে রোড ডিভাইডার না থাকা, অন্ধবাঁকে গাছপালায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি।
৪. মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা।
৫. উল্টো পথে যানবাহন, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহণ।
৬. অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অতিরিক্ত যাত্রী বহন।
৭. বেপরোয়া যানবাহন চালানো এবং একজন চালক অতিরিক্ত সময় ধরে যানবাহন চালানো।
দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সুপারিশসমূহ:
১. মোটরসাইকেল ও ব্যাটারিচালিত রিকশা আমদানি ও নিবন্ধন বন্ধ করা ।
২. জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতের বেলায় অবাধে চলাচলের জন্য আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করা।
৩. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ, যানবাহনের ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফিটনেস প্রদান।
৪. গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় মহাসড়কে সার্ভিস লেইনের ব্যবস্থা করা।
৫. সড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা সুনিশ্চিত করা।
৬. মহাসড়কে ফুটপাত ও পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা রাখা, রোড সাইন, রোড মার্কিং স্থাপন করা।
৭. সড়ক পরিবহণ আইন যথাযথভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা।
৮. উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৯. মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেইফটি অডিট করা।
১০. মেয়াদোত্তীর্ণ গণপরিবহন ও দীর্ঘদিন যাবৎ ফিটনেসহীন যানবাহন স্ক্র্যাপ করার উদ্যোগ নেওয়া।
১১. ঈদের ছুটি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া।
তবে এবারের ঈদে দুর্ঘটনার সংখ্যা গত বছরের তুলনায় কম বলেও জানায় বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বিগত ২০২৪ সালের ঈদুল ফিতরে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১৩৯৮ জন আহত হয়েছিল। বিগত বছরের সাথে তুলনা করলে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ২১.০৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২০.৮৮ শতাংশ, আহত ৪০.৪১ শতাংশ কমেছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।
মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর ঈদ কেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনা আশংকাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সংগঠনটি ঈদযাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানির বিষয়টি দীর্ঘদিন যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে আসছে। তবে এবার দীর্ঘ ছুটির কারণে ধাপে ধাপে বাড়ি ফেরার সুযোগ হওয়ায় ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হওয়ার পাশাপাশি দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা কিছুটা কমেছে বলে সংগঠনের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে।
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, দেশের সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় ভালো থাকায়, সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, হাইওয়ে পুলিশ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কার্যক্রম ছিল যাত্রীবান্ধব ও দৃশ্যমান।
প্রসঙ্গত, যাত্রী সাধারণ অসংগঠিত ও সচেতন না হওয়ায় অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য ও পথে পথে যাত্রী হয়রানি চরমে পৌঁছেছিল। গণপরিবহনগুলোতে ঈদকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্যের কারণে বাসের ছাদে, ট্রেনের ছাদে, খোলা ট্রাকে, পণ্যবাহী পরিবহনে যাত্রী হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দরিদ্র লোকজনদের ঈদে বাড়ি যেতে হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বর্তমান সরকারের সময়ে সড়কে মাফিয়া সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়ায় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর অবস্থানে থাকায় সড়কে খানিকটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে।
তিনি বলেন, দীর্ঘ ছুটির কারণে ধাপে ধাপে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ কাজে লাগানোর কারণে স্বস্তিদায়ক যাতায়াতের পাশাপাশি দুর্ঘটনা কিছুটা কমেছে। এইজন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি আগামীতে এইধারা অব্যাহত রাখার দাবি জানান।
এর পাশাপাশি দক্ষ চালক গড়ে তোলা, উন্নত বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনিয়ম দুর্নীতি ও মালিক সমিতির প্রভাব মুক্ত রাখা, মহাসড়কে ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচল বন্ধ করা, নিষিদ্ধ ত্রি-হুইলার, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করা, মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের আমদানি বন্ধ করে দেশব্যাপী উন্নতমানের আধুনিক বাস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ জকরিয়া, যুগ্ম মহাসচিব তাওহীদুল হক লিটন, অর্থ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান রাসেল, প্রচার সম্পাদক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন মাসুদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ রফিকা আফরোজ, মোহাম্মদ আরিফ, মনজুর হোসের ইশাসহ অন্যান্যরা।
বাংলাফ্লো/এসবি
Comments 0