Logo

বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কাজ করা ৬৩% নারী কর্মী জরায়ু সংক্রমণে ভুগছেন

রাজধানীতে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ বর্জ্য কর্মী কাজ করেন, যার মধ্যে ২ হাজার ৭৩০ জনই নারী।

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাফ্লো প্রতিনিধি

ঢাকা: ভোর ৪টা ৩০ মিনিট। শহরের অলিগলিতে যখন নিস্তব্ধতা বিরাজ করে, তখনই শুরু হয় একদল নারীর যুদ্ধ। টন টন বর্জ্য সংগ্রহ করে শহরকে বাসযোগ্য করা এ যোদ্ধাদের আমরা চিনি ‘বর্জ্য পরিষ্কারের কর্মী’ হিসেবে। কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার নির্মম বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি? বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধীনে অনেক প্রকারের কাজ করা হয়। তার মধ্যে রয়েছে নগর পরিষ্কার‑পরিচ্ছন্ন রাখা, বর্জ্য সংগ্রহ, বর্জ্য অপসারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, রাস্তা ও ড্রেন পরিষ্কার করা।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী (২০২৪), রাজধানীতে প্রায় ৬ হাজার ৫০০ বর্জ্য কর্মী কাজ করেন, যার মধ্যে ২ হাজার ৭৩০ জনই নারী। এই নারীরা প্রতিদিন গড়ে ১০-১২ ঘণ্টা কাজ করে মাত্র ২৫০-৩০০ টাকা মজুরি পান, যা বাংলাদেশের শ্রম আইনে নির্ধারিত ন্যূনতম মজুরির চেয়ে অনেক কম (বাংলাদেশ শ্রম অধিদপ্তর, ২০২৪)।

স্বাস্থ্যঝুঁকির ভয়াবহ চিত্র

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ২০২৪ সালের গবেষণা থেকে জানা যায়, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত নারীদের ৮৯ শতাংশ দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসকষ্টে ভুগছেন, যা সরাসরি বর্জ্য পোড়ানোর ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত। আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে তাদের প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত তথ্যে। আইসিডিডিআরবি‑এর ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ৭৮ শতাংশ নারীকর্মী পিরিয়ডের সময় পুরোনো কাপড় ব্যবহার করেন, ৬৩ শতাংশ জরায়ু সংক্রমণে ভুগছেন এবং ৪১ শতাংশের বেশি কর্মীর গর্ভপাতের অভিজ্ঞতা রয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ২০২৩ সালের এক গবেষণা আরও উদ্বেগজনক তথ্য দেয়। এতে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ নারী বর্জ্য কর্মী বিষণ্নতায় ভুগছেন এবং ৫৪ শতাংশ নারী কর্মী নিয়মিত অনিদ্রা ও মাথাব্যথায় আক্রান্ত।

বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন ও মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. গাওসিয়া ডব্লিউ চৌধুরী তাঁর গবেষণায় জানান, নারী বর্জ্য কর্মীরা শুধু বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শেই আসেন না, তাঁরা সমাজে গভীরভাবে অবহেলিত। তাঁদের সন্তানেরা স্কুলে যায় না, স্বামীরা প্রায়ই মাদকাসক্ত। তাই এই পেশা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, সামাজিক বিপর্যয়ের কারণও বটে।

বিএসএমএমইউ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মো. খালেকুজ্জামান পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার বর্জ্য কর্মীদের ৯০ শতাংশ কোনো ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম (পিপিই) ছাড়াই কাজ করেন। তাঁরা প্রতিদিন দুই শতাধিক ধরনের রোগজীবাণু এবং ভারী ধাতুর (সিসা, পারদ) সংস্পর্শে আসেন। ফলে তাঁদের গড় আয়ু সাধারণ মানুষের চেয়ে ১০-১৫ বছর কমে যায়। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে জরুরি ভিত্তিতে এই শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবীমা এবং নিয়মিত চিকিৎসা সেবার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

নিজের দেখা নির্মম বাস্তবতা

সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট এবং প্লাস্টিক বর্জ্য রিসাইক্লিং সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছি, তা হৃদয়বিদারক। গত সপ্তাহেই মিরপুরের একটি রিসাইক্লিং ইউনিটে জাহানারা আপাকে দেখেছি তাঁর আঙুলের ডগা পঁচে গেছে বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রভাবে। তবুও তাঁকে প্রতিদিন সকাল ৫টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই কাজ করতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এই আয় ছাড়া পরিবার চালানোর অন্য কোনো উপায় নেই!’ আরও মর্মান্তিক হচ্ছে, এই খাতের ৩০ শতাংশ কর্মীই ১৪-১৮ বছর বয়সের কিশোরী, যারা স্কুলের ব্যাগ ফেলে বর্জ্য সংগ্রহের থলে কাঁধে নিয়েছে। গতমাসে ডেমরায় পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, ৫৮ শতাংশ নারী কর্মী মাসিকের সময়ে কোনো সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাঁদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

মাঠপর্যায়ে কথা বলতে গিয়ে মিরপুরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নারী কর্মী শাহিনা বেগম (৩৫) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১২ বছর ধরে এই কাজ করছি। তিনবার গর্ভপাত হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, বিষাক্ত বর্জ্যের কারণে গর্ভপাত ঘটেছে। কিন্তু কাজ ছাড়ার কোনো উপায় নেই।

এই চিত্রগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়। এসব সমাজে গভীর নৈতিক সংকট তৈরি করছে। এই পেশায় যুক্ত নারীরা তাদের ভবিষ্যৎ বিসর্জন দিচ্ছে। আর বয়স্করা শেষ বয়সে এসে অমানবিক পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে। এই নারী ও কিশোরীদের অধিকার আদায়ে আমাদের সবারই দায়িত্ব রয়েছে। কারণ, তাদের এই কষ্ট আমাদের সমষ্টিগত ব্যর্থতারই প্রতিচ্ছবি।

সরকারি উদ্যোগ

ঢাকায় সিটি করপোরেশন ২০২২ সালে নারী বর্জ্য কর্মীদের জন্য সুরক্ষা সরঞ্জাম বিতরণের প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কর্মী এখনও গ্লাভস বা মাস্ক পায়নি। অন্যদিকে, ২০২৩ সালে চালু হওয়া স্বাস্থ্যবীমা প্রকল্পে মাত্র ১৫ শতাংশ নারী কর্মী নিবন্ধিত হয়েছে (স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ২০২৪)। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভারতের চেন্নাই ও থাইল্যান্ডের ব্যাংককে নারী বর্জ্য কর্মীদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য ক্লিনিক ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র চালু হয়েছে, যা বাংলাদেশে এখনও অনুপস্থিত।

এই সংকট সমাধানে জরুরি ভিত্তিতে নারী বর্জ্য কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবীমা চালু করা প্রয়োজন। প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য কর্মীদের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন এবং মাসিক সর্বনিম্ন মজুরি ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা এখন সময়ের দাবি। শিশুদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করলে নারী কর্মীদের কাজের মান বাড়বে। পাঠকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আজই আপনার বাড়ির বর্জ্য আলাদা করুন। বিষাক্ত বর্জ্য আলাদা প্যাকেটে ফেলুন।

এই নারীদের ত্যাগের বিনিময়েই আমরা পরিষ্কার‑পরিচ্ছন্ন শহর পেয়ে থাকি। সময় এসেছে তাদের মর্যাদা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্ব নেওয়ার। একটি মাস্ক, এক জোড়া গ্লাভস কিংবা কিছু সহানুভূতি–এই ছোট ছোট উদ্যোগই পারে হাজারো নারী কর্মীর জীবন বদলে দিতে। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই অবহেলিত নারী যোদ্ধাদের জন্য একটি নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করি।

বাংলাফ্লো/এসকে

Post Reaction

👍

Like

👎

Dislike

😍

Love

😡

Angry

😭

Sad

😂

Funny

😱

Wow

Leave a Comment

Comments 0