আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ঢাকা: ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’ নামে একটি বিশাল অ্যান্টি-মাওবাদী অভিযান শুরু করে। ছত্তিশগড় ও তেলেঙ্গানার সীমান্তবর্তী কারেগুট্টালু পাহাড় অঞ্চলে মাওবাদী নেতাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রায় ২১ দিনব্যাপী এই অভিযান পরিচালিত হয়।
এটি ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘকালীন পরিকল্পিত নিরাপত্তা অভিযানগুলোর একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় আধাসামরিক বাহিনী সিআরপিএফ, রাজ্য পুলিশের স্পেশাল ফোর্স ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বিত অংশগ্রহণ ছিল, যা ‘সমন্বিত নিরাপত্তা অভিযানের’ একটি মডেল।
এই অভিযানের পেছনে রয়েছে ভারতের দীর্ঘকালীন অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকট—মাওবাদী বা নকশাল আন্দোলন। ষাটের দশকে গঠিত এই আন্দোলন মূলত বঞ্চিত, প্রান্তিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকারের পক্ষে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী লড়াই হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। পরবর্তী সময়ে এটি সহিংসতা, অপহরণ, অবৈধ অস্ত্রব্যবহার ও সরকারি প্রকল্পে হামলার মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপে পরিণত হয়।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ঘোষণা দিয়েছেন, ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যেই ভারত থেকে মাওবাদীদের সম্পূর্ণ নির্মূল করা হবে।
এই লক্ষ্য পূরণের জন্যই এখন ছত্তিশগড়ের নারায়ণপুর ও বিজয়পুর জেলায় চলছে এক তীব্র অভিযান—‘অপারেশন ব্ল্যাক ফরেস্ট’। অভিযানের শুরুর পর থেকেই কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় মাওবাদী নেতার মৃত্যু ঘটেছে, যাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার মোটা অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এই হত্যা অভিযানই কি সত্যি মাওবাদীদের অবসান ঘটাবে?
চলমান এই অভিযানে প্রথমবারের মতো ভারতের বিশেষ বাহিনী—‘কোবরা ফোর্স’—সম্পূর্ণ ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে। তারা শুধু অস্ত্রশস্ত্রে আধুনিক নয়, নজরদারিতেও আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এগিয়ে।
মাওবাদী বাহিনী তাদের ঐতিহ্যবাহী গেরিলা কৌশল ব্যবহার করলেও এখন আর বনভূমি তাদের জন্য নিরাপদ এলাকা নয়।
সরকার দাবি করছে, এবারের অভিযানে অন্তত ৫৫০ জন মাওবাদীকে হত্যা করা হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, অনেক ক্ষেত্রেই এসব মানুষ সংঘর্ষে নিহত হননি, বরং ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে। বহু মরদেহ পরিবারকে ফিরিয়ে না দিয়ে সরাসরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলে অনেকে মনে করছেন।
মাওবাদী রাজনীতি মূলত ভর করে সমাজের সেই স্তরের ওপর, যেখানকার মানুষের কাছে রাষ্ট্র মানেই দমন আর শোষণ।
দারিদ্র্য, জমি কেড়ে নেওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদের করপোরেট লুট এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হয়রানি—এসবই ওই মানুষদের একসময়ে ঠেলে দিয়েছিল মাওবাদী আদর্শের দিকে।
কিন্তু এখন দৃশ্যপট কিছুটা বদলেছে। জঙ্গলঘেরা রেড জোনে অনেক জায়গায় আদিবাসীরা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সঙ্গে বেশি পরিচিত হয়ে উঠছে। সরকার নানা উন্নয়ন প্রকল্প, পুনর্বাসন কর্মসূচি এবং আত্মসমর্পণকারীদের জন্য পুরস্কার ঘোষণার মাধ্যমে এই অঞ্চলে মাওবাদীদের ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলেছে। ফলে একসময় যে এলাকাগুলো ছিল মাওবাদীদের শক্ত ঘাঁটি, সেখান থেকেই এখন অনেকেই অস্ত্র ফেলে সরকারি বাহিনীর দিকেই ফিরছে।
মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এ অভিযান নিছক নিরাপত্তা অভিযান নয়—এতে রয়েছে অর্থনৈতিক হিসাবনিকাশও। ছত্তিশগড় ও আশপাশের জেলায় লুকিয়ে আছে বিপুল পরিমাণ খনিজ সম্পদ—লোহা, কয়লা, বক্সাইট, ইউরেনিয়ামসহ নানা মূল্যবান সম্পদ। এগুলো করপোরেটদের হাতে তুলে দিতে গেলে আদিবাসী প্রতিরোধ এক বড় বাধা। আর প্রতিরোধে যারা সংগঠিত করছে, তারাই মাওবাদী।
সুতরাং সরকারের অভিযান শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিতে নয়, বরং এই অঞ্চলে খনিজ সম্পদের নির্বিঘ্ন উত্তোলন নিশ্চিত করতেও। তাই মাওবাদী নির্মূল মানে শুধু সশস্ত্র গেরিলাদের খতম নয়, বরং স্থানীয় প্রতিরোধ ক্ষমতাকে চূড়ান্তভাবে ভেঙে ফেলা।
চীনে মাও সে তুং আজ ইতিহাসের বিষয়, কিন্তু ভারতে তার নাম ধারণ করে আদর্শিক সংগ্রাম এখনো জীবিত। চারু মজুমদারের নেতৃত্বে শুরু হওয়া নকশাল আন্দোলনের ছায়া এখনো রয়ে গেছে ছত্তিশগড়, ওডিশা, ঝাড়খণ্ড, বিহারের কিছু অঞ্চলে।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় মাওবাদীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বড় প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিকভাবে তারা একঘরে, আদিবাসীদের সমর্থনেও ভাটা পড়ছে, আর সংগঠনের নেতৃত্ব স্তরে বারবার হত্যা ও ধরা পড়ার ঘটনা সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই সামনে আনছে।
তবে ভারতীয় সমাজে যে দারিদ্র্য, বৈষম্য এবং সামাজিক বঞ্চনা এখনো তীব্র, তা কিন্তু মাওবাদীদের জন্য জীবিত রাখে একটি ‘কারণ’। সমাজ যদি এসব প্রশ্নের জবাব না দেয়, তাহলে মাওবাদী রাজনীতিও বারবার ফিরে আসতে পারে নতুন নামে, নতুন রূপে।
অমিত শাহের ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৬ সালের মার্চ মাসেই মাওবাদমুক্ত ভারত দেখতে চায় সরকার। কিন্তু সামরিক অভিযানে যতই সাফল্য আসুক, মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সামাজিক অসন্তোষ যদি দূর না হয়, তাহলে সেই লক্ষ্য শুধু কাগজে-কলমেই সফল হবে।
তাই বিশ্লেষকদের একাংশ বলছেন, এখন সময় মাওবাদীদের কেবল গুলি করে শেষ করার নয়, বরং সেই বাস্তবতা বদলানোর— যেখান থেকে এই আন্দোলনের জন্ম।
বাংলাফ্লো/আফি
Like
Dislike
Love
Angry
Sad
Funny
Wow
Comments 0