বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সমাজে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়তে থাকে এবং অপরাধমূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। শুরুর দিকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি টালমাটাল অবস্থায় থাকলেও, বর্তমানে তা কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরেছে। এতেও জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা কাটেনি।
সামপ্রতিক এক সরকারি জরিপ বলছে, দেশের অর্ধেক নাগরিক এখনো হামলা ও লুটপাটের ভয়ে দিন কাটাচ্ছে, বিশেষ করে নারীরা এবং শহরের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কে রয়েছে।
গাজীপুরের শ্রীপুর মহাসড়কে গত ২০ জুন শুক্রবার ডাকাতির ঘটনায় দুজন নিহত হয়। এর দুই দিন পরই একই উপজেলার আনসার টেপিরবাড়ি এলাকায় চিকিৎসক দম্পতির বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। প্রথমে মহাসড়ক, তারপর বাড়ি—অপরাধীরা বুঝিয়ে দিয়েছে কোনো স্থানেই তাদের থামানো যায় না। তাই স্থানীয়দের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আরো বেড়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে (সিপিএস) ২০২৫’ অনুযায়ী, দেশের ৪১.৭৪ শতাংশ মানুষ বাড়িঘরে হামলার, আর ৪৭.১৭ শতাংশ মূল্যবান সম্পদ লুটপাট বা চুরির শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, নারীদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ (৪৯.৮৮ শতাংশ) মূল্যবান সম্পদ হারানোর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
জরিপটি পরিচালিত হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। দেশের ৬৪ জেলার এক হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট থেকে সংগ্রহ করা হয় তথ্য। এতে অংশ নেন ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সী আট লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ জন নারী-পুরুষ।
এই জরিপের মাধ্যমে এসডিজি ১৬-এর ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সূচক—নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্য মূল্যায়ন করা হয়েছে।
গ্রামে তুলনামূলক নিরাপদ
জরিপে দেখা গেছে, ৮৪.৮১ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছে, সন্ধ্যার পরও তারা নিজ এলাকায় নিরাপদ বোধ করে। এই নিরাপত্তা-বোধ শহরের (৮৩.৭৫ শতাংশ) চেয়ে গ্রামে (৮৫.৩ শতাংশ) বেশি।
নিজ ঘরে নিরাপদবোধ করেন কি না—এমন প্রশ্নে ৯২.৫৪ শতাংশ নাগরিক বলেছে, তারা ঘরে নিরাপদ। এখানেও গ্রাম এগিয়ে।
গ্রামে ৯২.৮৪ শতাংশ, শহরে ৯১.৮৮ শতাংশের এই বিশ্বাস।
ছিনতাই ও ডাকাতির সময় হামলার শঙ্কা
৩৩.৯১ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, ছিনতাই বা ডাকাতির সময় শারীরিক হামলার আশঙ্কা রয়েছে। গ্রামের তুলনায় শহর এলাকায় এমন শঙ্কায় বড় পার্থক্য দেখা গেছে। শহর এলাকায় ৪১.২৮ শতাংশ হামলার শঙ্কার কথা জানিয়েছে, যেখানে গ্রাম এলাকায় ৩০.৫ শতাংশ।
বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের শঙ্কা
৪১.৭৪ শতাংশ মানুষ আশঙ্কা করছে, তাদের বাড়িঘরে হামলা বা চুরি-ডাকাতি হতে পারে। শহরের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এমন হামলার শঙ্কা বেশি। শহরের ৪৪.৫৫ শতাংশ বলছে, তারা বাড়িঘরে হামলা বা চুরি-ডাকাতির শঙ্কা করছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাম এলাকার ৪০.৪৩ শতাংশ এমন কথা জানিয়েছে।
মূল্যবান সম্পদ চুরি বা লুটপাটের শঙ্কা
মূল্যবান সম্পদ চুরি বা লুটপাটের আশঙ্কায় রয়েছে ৪৭.১৭ শতাংশ। শহর এলাকার অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী এ শঙ্কায় রয়েছে। শহর এলাকায় ৫০.৫৫ শতাংশ জনগোষ্ঠী দাবি করেছে, তারা মূল্যবান সম্পদ চুরি বা লুটপাটের শঙ্কায় রয়েছে, যেখানে গ্রাম এলাকায় ৪৫.৬১ শতাংশ এমন শঙ্কা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি নাগরিক নিরাপত্তা, বিশেষ করে নারী ও শহরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক টানাপড়েন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থার ঘাটতি এই উদ্বেগের পেছনে কাজ করছে।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘দুঃখজনক, আমরা নারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি। দেশ, রাজনীতি, সমাজে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি গণপরিবহন এবং সড়কে নারী এবং কন্যাশিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।’
বাংলাফ্লো/এনআর
Comments 0