বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর মোড়ে সেদিন আগুনে পুড়ে যায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করা সন্তুর রেস্টুরেন্ট। সেটি আর চালু করা যায়নি। একইভাবে পটপরিবর্তনের পর সারা দেশে বন্ধ হয়েছে অনেক রেস্তোরাঁ এবং ফাস্টফুডের দোকান। তবে তার প্রকৃত হিসাব কারও কাছে নেই। এমনকি সারা দেশে কী পরিমাণ রেস্তোরাঁ, ফাস্টফুড ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে তারও হিসাব কারও জানা নেই। বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, ভয়াবহ রকমের ঝুঁকিতে আছে রেস্তোরাঁ ব্যবসা। তাদের মতে, অন্তত ৩০ শতাংশ ব্যবসা কমে গেছে ৫ আগস্টের পর।
ফেসবুকে রেস্টুরেন্টের মালামাল সহজে বিক্রি করার বেশ কয়েকটি গ্রুপ আছে। সেখানে দেখা যায়, প্রতিদিনই কেউ না কেউ রেস্তোরাঁ বিক্রি কিংবা রেস্তোরাঁর আসবাবপত্র বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। সেখান থেকে দেখা যায়, কেউ ওভেন, চুলা, ফ্রিজ, চেয়ার টেবিল, তন্দুর চুলা অথবা পুরো রেস্টুরেন্ট সেটআপ বিক্রির বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। চাঁদপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, এমনকি চট্টগ্রাম থেকেও বিক্রির বিজ্ঞাপন সেখানে দেখা যায়। আবার কেউ কেউ রেস্টুরেন্ট বিক্রি না করে ভাড়া দিতে চাচ্ছেন। গত ৫ মাসে দেওয়া এমন কয়েকটি বিজ্ঞাপনদাতার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, অধিকাংশ মালিকই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে না পেরে বিক্রি করে দিচ্ছেন। মালিকানা দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক চাপের কারণে এসব রেস্তোরাঁ বিক্রি করতে চাচ্ছেন।
মিরপুর রোডে মেট্রো শপিং মল থেকে একটু সামনে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছিল হট হাট ফুড লিমিটেড নামে একটি রেস্তোরাঁ। গত বছরের সেপ্টেম্বরের পর থেকে এই রেস্তোরাঁর কার্যক্রম বন্ধ। একই ভবনে ব্যবসা করা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কথা বলে জানা যায়, রেস্তোরাঁটি সেখানে ফ্লোর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে আসছিল। তবে একটি গ্রুপ অব কোম্পানি সেখানে দখল নেয়। এরপর রেস্তোরাঁর যাবতীয় অংশ ভেঙে ফেলা হয়। সেটি এখন সেভাবেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। তবে হট হাট ফুড লিমিটেডের ফেসবুক পেজে রেস্তোরাঁ বন্ধ করার কোনও ঘোষণা নেই। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে ফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়, তবে ফেসবুকে মেসেজ করা হলে তারা জানায়, সংস্কার কাজের জন্য সাময়িক বন্ধ আছে।
পরিসংখ্যান কী বলছে
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির কাছে দেশে হোটেল রেস্টুরেন্টের প্রকৃত সংখ্যা নেই। তবে তাদের সদস্য সংখ্যা ৬০ হাজার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২১ সালে হোটেল-রেস্তোরাঁর একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। সেখান থেকে জানা যায়, ১৯৯২-৯৩ অর্থবছরে দেশে হোটেল রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৭ হাজার ৯৮১টি, ২০০২-০৩ অর্থবছরে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ১৫ হাজার ১০৩টিতে। এরপর ২০০৯-১০ অর্থবছরে হোটেল রেস্তোরাঁর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ৭৫ হাজার ৩২৪টি এবং ২০২১ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪ -এ। অর্থাৎ ২০১০ সালের পর ১০ বছরে ১ লাখ ৬০ হাজার ৯৫০টি নতুন রেস্তোরাঁ প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে।
বিবিএস’র প্রতিবেদনে বলা হয়, জিডিপিতে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট প্রতিষ্ঠানের অবদান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৯-১০ সালে স্থূল মূল্য সংযোজন নিরূপণ করা হয়েছিল ১১ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু ১০ বছর পর তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ২০১৯-২০ এ স্থূল মূল্য সংযোজন নিরূপণ করা হয়েছে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে হোটেল ও রেস্টুরেন্ট উপখাত অর্থনীতিতে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে এবং এই খাতের অবদান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
তবে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি বলছে, বর্তমানে জিডিপিতে রেস্তোরাঁ খাতের অবদান প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
রেস্তোরাঁ ব্যবসার বর্তমান পরিস্থিতি
ঢাকার স্বনামধন্য বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রেস্তোরাঁ ব্যবসায় কিছুটা মন্দা চলছে। এর পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাজনিত বিষয়টি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। রাজধানীর গুলশান-বনানী এলাকার বেশ কিছু রেস্তোরাঁ মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। তবে বেশিরভাগ রেস্তোরাঁর গ্রাহক অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় সেখানেও বিক্রির পরিমাণ কমেছে। আবার রাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে অনেক ক্রেতা রেস্তোরাঁয় যেতে চান না।
রাজধানীর বনানী-১১ নম্বর রোডের একটি রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের এখানকার অনেক রেগুলার কাস্টমারই দীর্ঘদিন আসছেন না। একেক দিন বিক্রির পরিমাণ একেক রকম। বৃহস্পতি কিংবা শুক্রবার কিছুটা বাড়লেও তা আগের মতো নয়।’
গুলশান-২ নম্বরের একটি অভিজাত থাই কুইজিন রেস্তোরাঁয় আগে থেকে টেবিল বুকিং করে আসতে হয়। না হলে জায়গা পাওয়া যায় না। প্রতিদিন সেই রেস্তোরাঁ অতিথিতে ভরপুর থাকতো। এখন সেই পরিস্থিতি নেই বলে জানিয়েছেন সেখানকার একজন কর্মকর্তা। তবে তিনি আর বিস্তারিত কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
স্বনামধন্য কাচ্চি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান সুলতান’স ডাইনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা সাজিদ জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে তো এই মুহূর্তে কিছুটা অস্থিরতা আছে। বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলন হলে বিক্রিতে একটু প্রভাব পড়েই। কারণ আন্দোলন হলে মানুষ বের হয় না বা আসতে পারে না। দ্বিতীয়ত আমরা যে প্রডাক্ট বিক্রি করি সেটি তৈরি করতে যে মসলা লাগে সেটির দাম কিন্তু কমেনি, বরং বাড়ছে। সে কারণে এখন ব্যবসা থেকে প্রত্যাশিত লাভ করা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমরা তো ক্রেতাদের কথা মাথায় রেখে খাবারের দাম বাড়াতে পারি না। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির একটা ইস্যু আছে। এখনও পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়নি, তাই রাতে আমরা অনেক সময় গেস্ট পাচ্ছি না। ঢাকার বাইরে আমাদের যে শাখাগুলো আছে সেখানে অনেক জায়গায় রাতে গেস্ট আসে না। আমরা বর্তমানে এই ধরনের বেশ কিছু ইস্যুর মুখোমুখি হচ্ছি।‘
তিনি আরও বলেন, ‘রেস্তোরাঁ ব্যবসা বর্তমান সময়ে একটু কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের অনেক শাখা আছে সারা দেশে, বিভিন্ন আইটেম আনছি গেস্টদের জন্য, সেটার প্রশংসা পাচ্ছি। কিন্তু অনেকে তা করতে পারছে না। বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনের কারণে রাস্তায় জ্যামের মধ্যে বসে থাকতে হয়। এই কথা চিন্তা করে বাসা থেকে কিংবা অফিস থেকে অনেকেই বের হয় না, আসতে চায় না। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া উচিত। কারণ জিডিপিতে এই সেক্টরের অনেক বড় কন্ট্রিবিউশন আছে।’
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘আমাদের রেস্তোরাঁ শিল্পের অবস্থা খুবই খারাপ। আমি নিজে ৩টি রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দিয়েছি। আরও কয়েকটা বন্ধ হওয়ার পথে। এখানে যা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে প্রতিষ্ঠান আছে, কিন্তু মালিক কয়েকবার বদল হয়ে গেছে। আমরা ব্যবসায়ীরা খুব ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে আছি। আমাদের খাতের শ্রমিকদের মজুরি নিজেদের মতো করে ঠিক করে দিয়েছে, আমাদের সঙ্গে কোনও আলাপ করেনি। আমরা কোত্থেকে দেবো মজুরি? আমাদের তো থাকা-খাওয়ার সব খরচ দিতে হয় এবং বেশিরভাগই দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কাজ করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার পরিবর্তনের পর থেকে দেশে অরাজকতা চলছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি ঠিক হয়নি, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। সব মিলিয়ে প্রভাব পড়েছে রেস্তোরাঁ ব্যবসায়। অন্তত ৩০ শতাংশ বিক্রি কমেছে।’
বাংলাফ্লো/এসকে
Like
Dislike
Love
Angry
Sad
Funny
Wow
Comments 0