বাংলাফ্লো প্রতিনিধি
ঢাকা: ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা এটিএম আজহারুল ইসলামের বেকসুর খালাসের রায়ের পর সংবাদ সম্মেলনে আসেন দলের আমির শফিকুর রহমান।
মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ফাঁসির দণ্ড থেকে জামায়াতে ইসলামী নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম বেকসুর খালাস পাওয়ার পর উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন দলের আমির শফিকুর রহমানএ
মঙ্গলবার আপিল বিভাগ থেকে রায় আসার পর সংবাদ সম্মেলনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে আমরা এমন একটি সুবিচারপূর্ণ রায়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।”
রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে সেখানে জামায়াত নেতা কোনো প্রশ্ন নেননি।
২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এটিএম আজহারুলের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করে রায় দেয়। প্রায় চার বছর পর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগও এই রায় বহাল রাখে। এরপর থেকে জামায়াত নেতার রিভিউ আবেদন শুনানির অপেক্ষায় ছিল।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রিভিউয়ের অপেক্ষা থাকা মামলাটি নতুন করে আপিল বিভাগে শুনানি হয়।
শফিকুরের অভিযোগ, মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা পরিচালনায় সীমাহীন জাল-জালিয়াতি করা হয়েছে।
মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে আন্তর্জাতিক আইন বা দেশীয় আইনও অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ এনে তিনি বলেন, \আমাদের দেশে সাক্ষ্য আইন আছে, সেটা মোটেই ফলো করা হয়নি। সেদিন সংবিধান কোনো বিষয় ছিল না, আইন কোনো বিষয় ছিল না। যাদের ইশারায় তারা কোর্ট পরিচালনা করতেন তাদেরই ইচ্ছায় ছিল আইন। সেটা বৈধ হোক অথবা অবৈধ হোক।
“জুলুম করে, এক এক করে আমাদের বুক থেকে ১১ জন শীর্ষ দায়িত্বশীল নেতাকে মিথ্যা মামলায়, সাজানো পাতানো আদালতে এবং মিথ্যা সাক্ষীর মাধ্যমে কার্যত বিচারিক হত্যা করা হয়েছে।…বিচার নয়, পরিকল্পনামাফিক ঠান্ডা মাথায় নেতৃবৃন্দকে খুন করতে হবে, তার ছক বিচার বিভাগ এবং সরকার (আওয়ামী লীগ সরকার) মিলে তৈরি করেছিল।
“পাশাপাশি এমন পরিবেশ বাংলাদেশের সৃষ্টি করা হয়েছিল, যে এই পরিবেশে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সামান্য কোনো সুযোগ রাখা হয়নি”, বলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ শাসনামলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরুর পর দুটি ‘টর্চার সেল’ গড়ে তোলার অভিযোগও করেন জামায়াত নেতা।
তিনি বলেন, “একটা নাম দেয়া হয়েছিল সেফ হোম। আর একটা নাম দেয়া হয়েছিল সেফ হাউস। সেফ হোমে নেতৃবৃন্দকে নাজেহাল করা হতো।”
জিজ্ঞাসাবাদে সময় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসরণ করা হয়নি বলে অভিযোগ এনে শফিকুর বলেন, “নির্ঘুম রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন, তাদের উপর অত্যাচার চালানো হয়েছে।
\পাশাপাশি মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ধরে এনে সেফ হাউসে রাখা হতো। যাত্রাবাড়ীর একটা ঠিকানায়।\
জামায়াত আমির বলেন, \আমাদের নেতৃবৃন্দের উপরে জুলুম করা হয়েছে। বহু কায়দা কানুনে তাদের মুখ থেকে জোর করে, যা নয়, স্বীকার করানোর চেষ্টা করা হয়েছে। এমনকি রায় বাস্তবায়নের আগেও ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।”
সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন না করার অনুরোধও করেন জামায়াত আমির।
তিনি বলেন, “আজকে আমরা কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না, আজকের মোমেন্ট আমাদের জন্য ভিন্ন রকম, আপনারা বুঝতে পারছেন। এজন্য বিনয়ী অনুরোধ, মেহেরবানি করে আজকে আমাদের কেউ প্রশ্ন করবেন না।”
এই সংবাদ সম্মেলনের কিছুক্ষণ আগে আজহারকে বেকসুর খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর পুনর্গঠিত আপিল বিভাগ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া নেতাদেরকে নিয়ে আক্ষেপও করেন জামায়াত আমির।
তিনি বলেন, “আজ বড় মনে পড়ে, জাতির এই সংকট মুহূর্তে, কঠিন বাঁকে আমাদের মাথার তাজ সে সকল নেতৃবৃন্দ যদি বেঁচে থাকতেন! তারা তাদের প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে জাতিকে পথ দেখাতে পারতেন।\
'সেই নেতারা' বেঁচে থাকলে রাজনীতিতে অনেক গুণগত পরিবর্তন আসত বলেও দাবি করেন শফিকুর।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথমে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লা ফাঁসিতে ঝোলেন। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাত ১০টা ১ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে এই দণ্ড কার্যকর করা হয়।
২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল রাত ১০টা ১ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর করা হয় দলটির আরেক নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের, যিনি ময়মনসিংহ অঞ্চলে আলবদর বাহিনীর সংগঠক ছিলেন বলে রায়ে উঠে আসে।
২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর ফাঁসিতে ঝোলেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় এক পর্যায়ে জামায়াতে ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার ও আলবদর বাহিনীরও প্রধান হন বলে রায়ে উঠে আসে।
জামায়াতের সে সময়ের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি কার্যকর হয় ২০১৬ সালের ১১ মে রাতে। তিনি মুজাহিদের আগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘ ও আল বদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন বলে রায়ে উঠে আসে।
২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ফাঁসি কার্যকর করা হয় জামায়াতের নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানের। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানানো হয়।
২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রাতে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হয় গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলে আল বদর বাহিনীর সংগঠন ছিলেন বলে রায়ে বলা হয়।
এর বাইরে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমৃত্যু কারাদণ্ড নিয়ে বন্দি অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান ২০২৩ সালের ১৪ আগস্ট রাতে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গোলাম আযম ৯০ বছরের সাজা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ২০১৪ সালের ২৩ অক্টোবর। মুক্তিযুদ্ধে রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা পরিচয়ে গ্রেপ্তার হওয়া জামায়াত নেতা এ কে এম ইউসূফ ২০১৪ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বিচার চলাকালে কারাগারে মারা যান।
বাংলাফ্লো/আফি
Comments 0