Logo

প্রথম মুসলিম হিসেবে নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ইতিহাস গড়ার পথে জোহরান মামদানি!

নিউ ইয়র্ক এখন তাকিয়ে আছে সম্ভাব্য এক ইতিহাসের দিকে, যেখানে একজন তরুণ মুসলিম, অভিবাসীবংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ, দেশের অন্যতম শহরের নেতৃত্বে আসতে পারেন।

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাফ্লো ডেস্ক

ঢাকা: প্রথমবারের মতো একজন মুসলিম মেয়র পেতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কবাসী। নিউইয়র্ক সিটির ক্রমবর্ধমান ব্যয় সংকটের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রচার চালিয়ে আসা রাজ্যের অ্যাসেম্বলি সদস্য জোহরান মামদানি নগরের মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী বাছাইয়ে নাটকীয় জয়ের পথে রয়েছেন।

অভিবাসী অধ্যুষিত কুইন্স থেকে শুরু করে ব্রাউনস্টোন ব্রুকলিন পর্যন্ত বিস্তৃত বৈচিত্র্যময় ভোটার জোট তাকে এগিয়ে দিয়েছে।

ফলাফল এখনো চূড়ান্ত না হলেও ৩৩ বছর বয়সী এই ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট নিজেকে ইতিমধ্যে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী, সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো পরাজয় মেনে নিয়েছেন।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির অভিযোগে ২০২১ সালে পদত্যাগের পর রাজনীতিতে পুনরায় ফেরার চেষ্টা করছিলেন ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট কুমো। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সী মামদানির কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়েছে তাকে।

এক ভাষণে কুমো বলেন, “আজকের রাত জোহরানের রাত।”

জোহরান মামদানি যদি নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন, তবে তিনি হবেন নিউ ইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র। তার এই পরিচয় শহরের প্রায় ১০ লাখ মুসলমানের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ছড়িয়েছে। প্রচারপর্বে তিনি নিয়মিত মসজিদ পরিদর্শন করেছেন এবং ইসলাম ধর্ম ও নিজের বিশ্বাসকে তুলে ধরেছেন।

নির্বাচিত হলে মামদানি হবেন নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত মেয়র। পাশাপাশি, তিনিই হবেন শহরটির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রগতিশীল মেয়রপ্রার্থী, যিনি সরাসরি জনগণের দাবি ও দারিদ্র্য সমস্যা নিয়ে লড়াই করছেন।

‘আউটসাইডার’ থেকে নেতৃত্বে আসা কে এই মামদানি?

উগান্ডায় জন্ম নেওয়া জোহরান মামদানি মাত্র সাত বছর বয়সে নিউইয়র্কে আসেন। তাঁর মা বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মীরা নায়ার (‘সালাম বোম্বে!’, ‘দ্য নেমসেক’), আর বাবা মাহমুদ মামদানি একজন খ্যাতনামা নৃবিজ্ঞানী এবং ‘Good Muslim, Bad Muslim’ বইয়ের লেখক।

২০২০ সালে কুইন্স জেলার প্রতিনিধি হিসেবে নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলিতে নির্বাচিত হন মামদানি। তখন থেকেই তিনি নিজেকে প্রগতিশীল রাজনীতির কণ্ঠস্বর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন।

মাত্র কয়েক মাস আগেও জোহরান ছিলেন নিউ ইয়র্কবাসীর কাছে এক অচেনা নাম, একজন তরুণ রাজনীতিক যার পরিচিতি ছিল সীমিত।

কিন্তু আজ তিনি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মনোনয়ন পেতে চলেছেন, পরাজিত করেছেন আরও পরিচিত, অভিজ্ঞ এবং পুরোনো রাজনৈতিক ঘাঁটি গড়ে তোলা প্রার্থীদের।

তার প্রচারণার মূল প্রতিপাদ্য ছিল নিউ ইয়র্কের শ্রমজীবী মানুষের দুর্ভোগ, বিশেষ করে বাসস্থান ও শিশু পরিচর্যার চড়া ব্যয়।

আর তাই মামদানির সমর্থন বেড়েছে মূলত শ্রমজীবী, অভিবাসী এবং তরুণ ভোটারদের কাছ থেকে, যারা নিউ ইয়র্ক সিটির সামাজিক ন্যায় ও ব্যবহুল জীবনব্যবস্থার জন্য পরিবর্তন চায়।

অভিনব প্রচার ও সাহসী অবস্থান

প্রচারণায় মামদানি বিভিন্ন ভাষায় ভিডিও বার্তা প্রকাশ করেন—পুরো একটি ভিডিও ছিল উর্দুতে, যেখানে দেখা যায় বলিউডের ক্লিপও। অন্য ভিডিওতে তিনি কথা বলেন স্প্যানিশ ভাষায়। এসবই তাঁর বহুসাংস্কৃতিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও মানুষের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের সক্ষমতা তুলে ধরেছে।

তাঁর নির্বাচনী ইশতেহারে রয়েছে- নগরবাসীর জন্য বিনামূল্যে বাস চলাচল, সর্বজনীন শিশু পরিচর্যা, ভাড়া বাড়ি স্থগিতকরণ, ধনীদের ওপর নতুন কর আরোপ করে সরকারি গ্রোসারি চালু ইত্যাদি।

প্রচারণায় তিনি একবার বলেছিলেন, পাবলিক স্পেসে একজন মুসলিম হিসেবে দাঁড়ানো মানেই আমাদের মাঝে যেটুকু নিরাপত্তা আছে তা ত্যাগ করা।

ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে তিনি বরাবরই সরব। ২০২৩ সালে মামদানি এমন একটি বিল প্রস্তাব করেন, যার মাধ্যমে ইসরায়েলি বসতিতে সম্পৃক্ত নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক কিছু চ্যারিটিকে কর-ছাড় সুবিধা বাতিল করার দাবি জানানো হয়, যদিও রাজ্য অ্যাসেম্বলির নেতৃত্ব একে বাতিল করে।

তিনি গাজার ঘটনাবলীতে ইসরায়েলের ভূমিকার কড়া সমালোচক এবং বিডিএস (বয়কট,ডিভেস্টমেন্ট, সেংশনস) আন্দোলনের সমর্থক। এমনকি তিনি বলেছেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তার হওয়া উচিত।

তবে এইসব অবস্থানের মাঝেও মামদানি পরিষ্কার করেছেন নিউ ইয়র্কে কোনো ধরনের ইহুদিবিদ্বেষের স্থান নেই। তিনি বলেছেন, নির্বাচিত হলে ঘৃণাজনিত অপরাধ প্রতিরোধে আরও বাজেট বরাদ্দ করবেন। তার বক্তব্যে বারবার উঠে এসেছে, জায়নবাদের সমালোচনা মানেই ইহুদিবিদ্বেষ নয়।

নির্বাচনী প্রচারে এ বিষয়গুলো একটি স্পষ্ট বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বিশেষ করে শেষ সময়ে যখন একটি পডকাস্টে তিনি \গ্লোবালাইজ দ্য ইনতিফাদা\ স্লোগান সম্পর্কে সরাসরি কোনো আপত্তি জানাননি বা একে অস্বস্তিকর বলেননি। এই স্লোগানটিকে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও অনেক ইহুদি ভোটার একে সহিংসতার ডাক বলে বিবেচনা করেন।

রাজনৈতিক মূল্যায়ন

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ট্রিপ ইয়াং বলেন, “নিউইয়র্কের আধুনিক ইতিহাসে এটি অন্যতম বড় রাজনৈতিক বিস্ময়। এই শহরের ভোটাররা সাহসী, স্পষ্টভাষী নেতাদের চান—যেমন জোহরান মামদানি।”

কংগ্রেসওম্যান আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ ও সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স, যারা নিজেরাও ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট, তারা মামদানির প্রচারণায় সরাসরি সমর্থন জানিয়েছেন।

নিউইয়র্কে ‘র‍্যাংকড চয়েস’ পদ্ধতিতে নির্বাচন হওয়ায় চূড়ান্ত ফল আসতে কিছু সময় লাগবে, তবে কুমোর পরাজয় স্বীকার ইতোমধ্যে মামদানিকে বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছে। ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে জয় মানেই প্রায় নিশ্চিত মেয়র হওয়া—এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে নিউইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র হিসেবে জোহরান মামদানির নাম লেখানোর সম্ভাবনা এখন খুবই জোরালো।

নিউ ইয়র্ক এখন তাকিয়ে আছে সম্ভাব্য এক ইতিহাসের দিকে, যেখানে একজন তরুণ মুসলিম, অভিবাসীবংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ, দেশের অন্যতম শহরের নেতৃত্বে আসতে পারেন।

বাংলাফ্লো/এসবি

Leave a Comment

Comments 0